top of page

কবির শেষ লেখা

সেই সকাল থেকে কলম ধরে বসে আছেন কবি। একটা অস্থিরতা পেয়ে বসেছে, কিছু একটা না লিখলে কাটবে না। কবির মন বিক্ষিপ্ত নানা ভাবনায়- সেই সাতচল্লিশে পাকিস্তানের জন্ম লাভের পর থেকেই ওরা অন্য এক ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। পার্লামেন্টে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব তুলেছিলেন, বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, অন্য নেতারা তা কানে তোলেন নি। তারপর যতবারই সামনাসামনি ঘোষণা এসেছে, "উর্দুই হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা" ততবারই প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে ছাত্র, জনতা। মানুষ মাঠে নেমেছে, মিছিল করেছে, পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছে, জ়েলে পঁচেছে, তারপরও প্রতিবাদ থেকে সরে আসেনি। বায়ান্ন সাল এলো, এখনও সংগ্রাম চলছে। আর চলছে দমনের নোংরা অপচেষ্টা। আজও ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

কবি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। ফাল্গুন মাসের আট তারিখ। কৃ্ষ্ণচূঁড়া গাছটা দেখা যাচ্ছে, লাল ফুলে ভরে আছে। অজানা একটা পাখির গান ভেসে আসছে দূর থেকে, "বিষাদময় আনন্দের মত" ভাবেন কবি, একটু বিষণ্ণ হন, পাখির নাম না জানাটা কবির জন্য অন্যায়। তারপর ঘুরে ফিরে এক ভাবনা পেয়ে বসে কবিকেঃ আহারে বাংলা! মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, মুখের ভাষা - ওরা কেন কেড়ে নিতে চায়! কোন অধিকারে? কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কবি চর্যার কথা ভাবেন। অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে চর্যার কবিরা হয়েছিলেন দেশান্তরী। কিন্তু কয়েকশত বছর পর নেপালের এক গোয়ালঘর থেকে বেরোলো যে জীর্ণ অমূল্য পাণ্ডুলিপি, প্রাচীণতম বাংলা সাহিত্য, সেখানে তাদের ভাব ও দুঃখ-গাঁথা প্রমাণ করে দিল, নির্যাতনে থেমে যায়নি কানুদের কলম-

“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।

চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”(পঞ্চেন্দ্রিয় শাখা মন-তরুটাতে,/আশারূপ ফল পাতা শোভা পায় তাতে।)

ভাবেন কবি, মাগধী অপভ্রংশের সন্তান বাংলা তখন কেমন শিশুর মতোই চঞ্চল, অস্থির! তারপর কয়েক শতাব্দী অন্ধকারের পর বড়ুচণ্ডীদাস,আলাওলরা নিয়ে এলেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, পদ্মাবতীর ধারা, রচিত হতে লাগল ধর্মের নানা কথা-উপকথা। ভালোভাবে নিলেন না সেকালের ধর্ম ব্যবসায়ীরা, বললেন, বাংলার মতো ‘অপবিত্র’ ভাষায় ধর্ম কথা লিখলে যেতে হবে 'রৌরব' নরকে! ধর্মান্ধের প্রলাপে কিংবা সাম্রাজ্যবাদীর আগ্রাসনেও থেমে যায়নি এ ভাষা , অনেক দুঃখ কষ্ট সয়েও, অপবাদ লাঞ্ছণা বরণ করেও বাংলা ভাষা,সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কিছু অমর লেখক, সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের আধুনিক যুগের। আজ বাংলা কত সমৃদ্ধ হয়েছে! অন্তরাত্নার সাথে মিশে গেছে। কবির বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে, অল্পকিছু ক্ষমতাবান আজ এই ভাষাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে তাদের সাথে যোগও দিয়েছে কিছু ‘সুশীলজন’!

সভা বসে গেছে, কবি জানেন। এখনই যেতে হবে, অতি দ্রুত শার্ট পড়ে বের হন কবি, কবিতার খাতা শূণ্য পড়ে থাকে, ফেরা হয় না তার।

মিছিলের অগ্রভাগেই ছিলেন কবি, সকালে কয়েককাপ চা, আর দুপুরে খাওয়া হয়নি, পেটে একটা ব্যাথা চাপ ধরে ছিল। কিন্তু সেদিকে খেয়াল ছিল না তার, হাতে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” লেখা প্লাকার্ড, আর মুখে জোরালো স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলছিলেন তিনি। হঠাৎ গুলির শব্দ শুনলেন, আর সাথে সাথে আচমকা পেটের ব্যথাও চলে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা রক্তের ঝরণা ছুটল, সীমাহীন ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল তার প্রতি কোষে। কবির মনে হল হাতের প্লাকার্ড ঘুড়ি হয়ে আকাশে উড়ে গেল! তারপর সে আকাশও ঝাপসা হয়ে গেল। অস্পষ্ট কণ্ঠে কেবল বলতে পারলেন, “মা!”

মা জবাব দিলেন না, কেবল গভীর মমতায় সন্তানকে কোলে তুলে নিলেন। রাজপথের ধুলো মায়ের শাড়ির আঁচল হয়ে পরশ বুলিয়ে গেল।

 

পুনশ্চঃ ৬১ বছর পরে আরেক উত্তাল ফাল্গুনে এক অতি অধম তরুণ সেই কবির রক্ত দিয়ে লেখা শেষ কাব্যের মহান চিত্র তুলে ধরার আপ্রাণ (অপ)চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অধম তরুণের হৃদয় পড়ে আছে শাহবাগের গণজোয়ারে, তাই অজস্র ভুলসমৃদ্ধ লেখার ধৃষ্টতাও সবাই ক্ষমা করে দেবে বলে আশা করে বসে আছে। অস্থিরমতি এই তরূণ তার লেখার সূত্রাদি প্রদানে ব্যর্থ, চর্যার ২ ছত্রের তরজমাও তার নয়, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ থেকে ধার নেয়া।

দুই একুশ

 

২১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫২____________________
আজকের সকালটা বড় অদ্ভুত। বসন্তের সুবাসমাখা বাতাস-কোকিলের গান-ঝিলমিলে রোদ-নাহ, কার মনোযোগ নেই সেদিকে; হৃদয়জুড়ে একটি শব্দই বারবার বেজে উঠছে-বাংলা। বাংলা আমার মা।
মায়ের অমর্যাদা হতে দেব না। কেউ না।
সান্ধ্য আইন জারি করেছে সরকার, আর সারা দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তাই দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে কেউ কেউ। হঠাৎ গর্জে ওঠে কোন কণ্ঠস্বর-আমরা ১৪৪ ধারা ভাংবই, দেখি সরকারের বন্দুকে কত বুলেট জমা আছে।
আমরা রাজপথে নামলাম।
আমরা রাজপথে রইলাম।
রিকশাওলা এসে যোগ দিল আমাদের দলে। তারপর চাওলা, মজুর, কৃষক –সবাই এলো।
দুপুর গড়িয়ে গেল।
আমরা এগুতে শুরু করলাম।
কয়েকটা বুলেটের আওয়াজ।
আমার বুকের বাম পাশে হঠাৎ অনুভব করলাম তীব্র উষ্ণ এক স্রোত।
কি তীব্র যন্ত্রণা।
চিৎকার আর ছোটাছুটি।
শব্দগুলো ম্লান হয়ে আসছে। দৃশ্যগুলো ঝাপসা হয়ে আসছে।
তীব্র শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি আমি।
এই মধুর শব্দগুলো আর কখনো শুনতে পাব না, বলতে পারবনা-

 

মা আমি তোমায় ভালবাসি।
শহীদ মিনার তৈরি হল, শ্রদ্ধা জানাতে দলে দলে এলো মানুষ।
কিন্তু এ কী!
তুমি কেন এখানে আমায় অপমান করতে এসেছ?
তুমি ঘুষ খাও, দুর্নীতি কর। তুমি দেশের অর্থ বাইরে পাচার কর। তুমি মানুষকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে  তাদের কে ভুলে যাও।
তুমি বাংলায় কথা বলতে দ্বিধাবোধ কর।
হয়তো তুমি এদেশের হয়েও বাংলা বলতেই জাননা ঠিকমত।
তুমি পাস করে পাকাপাকি ভাবে বিদেশ যেতে চাও, দেশের প্রতি তোমার মনে কোন দায়বোধ নেই-ভাবো-দেশ আমাকে কী দিয়েছে?
তুমি খাবার ঘর-বসার ঘর-শোবার ঘর সবখানে ভিনদেশি ভাষা নিয়ে মেতে থাক।
আমি সহ্য করতে পারি না- খুব কষ্ট হচ্ছে- কষ্ট............
২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

 

সকল ভাষাশহীদ এবং ভাষাসৈনিকের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
আমি জানি না আমি এর যোগ্য কিনা, তবে সত্যি বলছি, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আগুনের আঁচের মতোই আমি কিছুটা অনুভব করতে পারি- আমারই বয়সে সেই সময়কার তরুণরা কিভাবে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে। আশা করি আমার এ ধৃষ্টতা বড় করে দেখবেন না কেউ। পলাশীর এই আড্ডা আর গানে ভরা ধুলোমাখা পথে যে রক্ত মেখে আছে, তা এখনও মুছে যায়নি, যাবে না কোনদিন।
রক্তের রত্নাক্ষরে তাঁরা যে স্বপ্ন লিখে গেছেন, তার উত্তরাধিকারী আমরাই।
>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
মা, বোধ হয়...আমি তোমাকে সত্যিই ভালবাসি।
৬০ বছর কেটে গেছে।
কিন্তু ‘আমরা এখনও নির্মাণবিদ্যা ভুলে যাইনি’।
-রহমতুল্লাহ রচি



© 2012 by Rahmatullah Roche. All rights reserved

bottom of page